ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) এর জীবনী

Table of Contents
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল | ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল এর জীবনী pdf | ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের জীবনী | ইমাম আহমদ বিন হাম্বল এর জীবনী | ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ এর জীবনী

ইমাম আমাদ বিন হাম্বল (রহ.)-এর পরিচয়

নাম : আহমাদ, পিতা মুহাম্মদ, দাদা হাম্বল। উপনাম : আবূ আব্দুল্লাহ।

বংশনাম : আহমাদ বিন মুহাম্মদ বিন হাম্বল বিন হিলাল বিন আসাদ বিন ইদ্রীস --- আশশায়বানী, আল-মারওয়ায়ী, আল-বাগদাদী। ইমামের ১৩তম পূর্ব পুরুষ শায়বান এর দিকে সম্পৃক্ত করায় আশ শায়বানী, তাঁর জন্মভূমি মুরউ এর দিকে সম্পৃক্ত করায় আল-মারওয়ায়ী, অতঃপর ইমামের অবস্থান বাগ্দাদ এর দিকে সম্পৃক্ত কারয় “আল বাগদাদী।”

 ইমাম আহমাদ (রহ.) এর জন্ম ও প্রতিপালন

ইমাম আহমাদ (রহ.) ১৬৪ হিঃ রবিউল আউয়াল মাসে মুরউতে জন্ম গ্রহণ করেন। কেউ কেউ বলেন তিনি মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থায় মুরউ হতে বাগদাদে আসেন অতঃপর বাগদাদে জন্ম হয়। ছোট কালেই তাঁর পিতা ইন্তেকাল করেন ফলে তিনি ইয়াতীম অবস্থায় মার কাছে পালিত হন।

 ইমাম আহমাদ (রহ.) এর শিক্ষা জীবন

ইমাম আহমাদ (রহ.) ছোট বয়সেই শিক্ষায় মনোনিবেশ হন। তিনি প্রখর মেধাশক্তিসম্পন্ন ছিলেন। অতি সহজেই অনেক কিছু মুখস্ত করে ফেলতেন। ইব্রাহীম আল হারবী (রহ.) বলেন : "মনে হয় যেন আল্লাহ তা'আলা ইমাম আহমাদকে আদি-অন্তের সকল প্রকার জ্ঞান দান করেছেন।'

শিক্ষা সফর : জ্ঞান পিপাসু ইমামুস সুন্নাহ্ ইমাম আহমাদ (রহ.) বাগদাদের উল্লেখযোগ্য সকল আলিম হতে শিক্ষা গ্রহণের পর বিভিন্ন প্রান্তে জ্ঞান আহরণে ছুটে চলেন। তিনি সফর করেন কুফা, বাসরা, মক্কা, মদীনা, ত্বারতুস, দামেস্ক, ইয়ামান, মিসর ইত্যাদি অঞ্চলে। তিনি পাঁচবার হাজ্জব্রত পালন করেন তন্মধ্যে তিনবার পায়ে হেঁটে হাজ্জ পালন করেন।

হাদীসের জগতে ইমাম আহমাদ (রহ.)

হাদীসের জগতে ইমাম আমাদ (রহ.) এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, তাঁর হাদীসের পারদর্শিতা সম্পর্কে এক কথায় বলা যায় তিনি হাদীসের এক বিশাল সাগর। ইমাম আব্দুল ওয়াহ্হাব আল ওয়াররাক বলেন, “আমি ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলের মত আর কাউকে দেখিনি, তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো আপনি অন্যের চেয়ে ইমাম আহমাদ (রহ.)-এর মাঝে জ্ঞান-গরিমা বা মর্যাদা বেশী কি পেয়েছেন? তিনি বললেন : ইমাম আহমাদ এমন একজন ব্যক্তি যাকে ৬০,০০০ (ষাট হাজার) প্রশ্ন করা হয়েছে তিনি সকল প্রশ্নের জবাবে হাদ্দাছানা ওয়া আখাবারানা অর্থাৎ হাদীস হতে জবাব দিয়েছেন অন্য কিছু বলেন নি।” অতএব এক বাক্যে বলা যায় যে, ইমাম আহমাদ (রহ.) হাদীসের সাগর ছিলেন। এ ছাড়াও এর জলন্ত প্রমাণ হলো ইমামের সংকলিত সুপ্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থ “আল মুসনাদ” যার হাদীস সংখ্যা চল্লিশ হাজার।

অতএব হাদীসের জগতে ইমাম আহমাদ (রহ.) এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। হাদীস শাস্ত্রে মুসতালাহ, ঈলাল, আসমাউর রিজাল, জারহ-তাদীল ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য কৃতিত্ব বিদ্যমান রয়েছে। হাদীস শিক্ষাদানেও তাঁর কৃতিত্ব অতুলনীয়, তাঁর একেক মজলিসে পাঁচ হাজারেরও অধিক ছাত্র অংশ গ্রহণ করত। 

আহলুস সুন্নাহর ইমাম আহমদ (রহ.)

ইমাম আহমাদ (রহ.) সকল প্রকার ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত কিন্তু প্রকাশ্যভাবে সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা হতে সামান্যতম ছাড় দিতে প্রস্তুত নন, প্রয়োজনে জীবন জেতে পারে তবুও সুন্নাহর অনুসরণ বর্জন হতে পারে না, ইমাম ইসহাক বিন রাহুয়াহ (রহ.) বলেন : “যদি ইমাম. আমাদ বিন হাম্বল না হতেন এবং তাঁর ইসলামের জন্য ত্যাগ স্বীকার না হত তাহলে ইসলাম বিনাশ হয়ে যেত, অর্থাৎ যখন সকলেই ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় কুরআনকে মাখলুক হিসাবে স্বীকার করে নিল, তখন পৃথিবীর বুকে একজনই মাত্র ইসলামের সঠিক বিশ্বাস ধারণ করেছিলেন, তিনিই হলেন ইমাম আহমাদ। আল্লাহ তা'আলা তাঁর মাধ্যমেই ইসলামের সঠিক আকীদাহ্ বিশ্বাসকে টিকিয়ে রেখেছিলেন। 

রাসূল ﷺ হতে চলে আসা কুরআনের সঠিক বিশ্বাস “কুরআন আল্লাহ তা'আলার বাণী, কোন সৃষ্ট বস্তু নয়।” কিন্তু জাহমিয়া ও মুতাযিলাদের আবির্ভাবে এ বিশ্বাসে বিকৃতি ঘটানো হয়, শুরু হল “কুরআন মাখলুক বা সৃষ্ট বস্তু” এ ভ্রান্ত বিশ্বাসের প্রচারণা, এমনকি রাষ্ট্রীয়ভাবে আব্বাসীয় খলীফা হারুনুর রশীদ এবং পরবর্তী খলীফা মামুনুর রশীদ প্রভাবিত হলেন এ ভ্রান্ত বিশ্বাসে। রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা হল সকলকে বিশ্বাস পোষণ করতে হবে যে, “কুরআন মাখলুক বা সৃষ্ট বস্তু", এ বিশ্বাসের কেউ দ্বিমত পোষণ করতে পারবে না। বাধ্য হয়ে ইচ্ছায় অনিচ্ছায় প্রায় সকলেই ঐক্যমত পোষণ করলেন শুধুমাত্র দু'জন দ্বিমত পোষণ করেন, ইমাম আহমাদ (রহ.) ও মুহাম্মাদ বিন নূহ (রহ.)। নির্দেশ দেয়া হল তাদেরকে গ্রেফতার করার জন্য। গ্রেফতার করে আনার পথে মুহাম্মদ বিন নূহ (রহ.) ইন্তেকাল করেন, আর ইমাম আহমাদ (রহ.) দু'আ করেছিলেন যেন খলীফা মামুনের সাথে সাক্ষাৎ না হয়। ইমামকে কারাবাস দেয়া হল, প্রায় আটাস (২৮) মাস কারাগারে আবদ্ধ হয়ে থাকলেন এবং খলীফা মু'তাসিম এর নির্দেশে ইমামকে তাদের ভ্রান্ত বিশ্বাস পোষণ না করায় বেত্রাঘাত করা হল। হাত বেঁধে নিষ্ঠুরভাবে কোড়াঘাত করা হয়। কোড়াঘাতে রক্ত ঝড়তে থাকে, গায়ের কাপড় পর্যন্ত রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়। জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পরে যান, আবার জ্ঞান ফিরলে জিজ্ঞাসা করা হয় তাদের ভ্রান্ত বিশ্বাসে একমত কিনা? একমত না হলে আবার কোড়াঘাত শুরু হয়। এভাবে নির্মম নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হন। এর কারণ শুধু একটিই তিনি কুরআন ও সুন্নাহর অনুসারী এবং বিদ'আতী বিশ্বাস বর্জনকারী। পরিশেষে খলীফা আল মুতাওয়াক্কিল (রহ.) সঠিক বিষয় উপলব্ধি করায় গোটা মুসলিম জাহানে হকের উপর প্রতিষ্ঠিত অনড়, অটল একক ব্যক্তি ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহ.)-কে কারামুক্ত করেন এবং তাঁকে যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করেন।

ইমাম আহমদ (রহ.) এর আকীদাহ্-বিশ্বাস

পৃথিবীর বুকে যখন ইচ্ছা-অনিচ্ছায় সকলেই মুতাযিলাদের বাতিল আকীদাহ-বিশ্বাস গ্রহণ করে তখন একক ব্যক্তি যিনি কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে সঠিক আকীদাহ্ বিশ্বাসের উপর অটল ছিলেন। এমনকি নির্মম, নিষ্ঠুর নির্যাতনেও তিনি সঠিক আকাদীহ্ হতে সামান্যতমও বিচ্যুত হননি। সুতরাং একবাক্যে বলা যায় যে, তিনি সঠিক আকীদায় শুধু বিশ্বাসী নয় বরং সঠিক আকীদায় বিশ্বাসীদের অন্যতম ইমাম ছিলেন।

ইমাম আহমাদ (রহ.)-এর শিক্ষকবৃন্দ

ইমাম আহমাদ (রহ.) বাগদাদসহ গোটা মুসলিম জাহানের প্রায় সকল শিক্ষা কেন্দ্রে জ্ঞানের সন্ধানে অবতরণ করেন, ফলে তাঁর শিক্ষক হাতে গনা কয়েকজন হতে পারে না বরং তাঁর শিক্ষক অগণিত ও অসংখ্য। ইমাম যাহাবী (রহ.) বলেন : ইমাম আহমাদ (রহ.) “মুসনাদে আহমাদ” গ্রন্থের হাদীসসমূহ যে সব শিক্ষক হতে গ্রহণ করেন তাঁদের সংখ্যা হলো দুইশত তিরাশি (২৮৩) জন। এছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে বহু সংখ্যক শিক্ষক রয়েছেন। নিম্নে প্রসিদ্ধ কয়েকজন শিক্ষকের নাম উল্লেখ করা হল :
  1. ইমাম সুফইয়ান বিন উয়ায়নাহ (রহ.)
  2.  ইমাম ওয়াকী বিন আল জাররাহ্ (রহ.)
  3. ইমাম মুহাম্মদ বিন ইদ্রীস আশ্শাফেয়ী (রহ.)
  4. ইমাম আব্দুর রায্যাক আস সানআনী (রহ.)
  5. ইমাম কুতাইবাহ বিন সাঈদ (রহ.)
  6. ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী (রহ.)
  7. ইমাম ইবনু আবী শাইবাহ (রহ.) ইত্যাদি

ইমাম আহমাদ (রহ.)-এর ছাত্র বৃন্দ

ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহ.)-এর ছাত্র অগণিত হওয়াই স্বাভাবিক, তাদের সংখ্যাও গণনা সম্ভব নয় এবং তালিকাও বর্ণনা সহজ নয়। যিনি লক্ষাধিক হাদীসের হাফেয, চল্লিশ হাজার হাদীস গ্রন্থের সংকলক তাঁর ছাত্র বিশ্বজুড়ে হওয়াই স্বাভাবিক। যার মাজলিসে পাঁচ হাজার পর্যন্ত ছাত্র থাকত, নিম্নে কয়েকজন নক্ষত্রতুল্য ছাত্রের নাম উল্লেখ করা হল :
  1. ইমাম মুহাম্মদ বিন ইসমাঈল আল বুখারী (রহ.)
  2. ইমাম মুসলিম বিন হাজ্জাজ আল কুশায়রী (রহ.)
  3. ইমাম আবূ দাউদ আস সিজিস্তানী (রহ.)
  4. ইমাম আবূ ঈসা অততিমিযী (রহ.)
  5. ইমাম আবূ আব্দুর রহমান আননাসাঈ (রহ.)
  6. ইমাম সালিহ বিন আহমাদ বিন হাম্বল (রহ.)
  7. ইমাম আব্দুল্লাহ্ বিন আহমাদ বিন হাম্বল (রহ.) ইত্যাদি।

ইমাম আহমাদ (রহ.)-এর রচনাবলী

প্রসিদ্ধ চারজন ইমামের মধ্যে যিনি সবচেয়ে বেশী গ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি হলেন ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহ.)। শুধু তাই নয় বরং তাঁর সংকলিত হাদীস গ্রন্থ “মুসনাদ" সর্ব প্রসিদ্ধ। ইমামের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ নিম্নে বর্ণনা করা হলো :

  1. হাদীস গ্রন্থ “আল মুসনাদ”
  2. আযযুহদ
  3. ফাযায়িলুস সাহাবাহ
  4. আল ঈলাল ওয়া মারিফাতির রিজাল।
  5. আল ওয়ার
  6. কিতাবুস সালাত
  7. আররাদ্দ আলাল জাহমিয়্যাহ
  8. রিসালাতু ইমাম আহমাদ
  9. আল মাসায়িল
  10. আহকামুন্নিসা
  11. কিতাবুল মানাসিক
  12. কিতাবুসন্নাহ, ইত্যাদি।

ইমাম আহমাদ (রহ.) সম্পর্কে আলিম সমাজের প্রশংসা 

১. ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী (রহ.) বলেন : আল্লাহ তা'আলা রাসূল ﷺ এর পর দু'জন ব্যক্তির মাধ্যমেই ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একজন হলেন আবূ বকর (রা.) যার মাধ্যমে মুরতাদ ও ভণ্ড নাবীদের দমন করেছেন, আর অপরজন আহমাদ বিন হাম্বল, যার মাধ্যমে কুরআনের মানহানীর সময় কুরআনকে সমুন্নত করেছেন

২. ইমাম আব্দুল ওয়াহ্হাব আল ওয়াররাক (রহ.) বলেন: “আমি ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলের মত আর কাউকে দেখিনি, তাকে জিজ্ঞাসা করা হল আপনি অন্যের চেয়ে ইমাম আহমাদের মাঝে জ্ঞান-গরিমার বা মর্যাদার বেশী পেয়েছেন কি? তিনি বললেন : ইমাম আহমাদ এমন একজন ব্যক্তি যাকে ৬০,০০০ (ষাট হাজার) প্রশ্ন করা হল, তিনি সকল প্রশ্নের জবাবে হাদ্দাছানা ওয়া আখারানা অর্থাৎ শুধু হাদীস হতে জবাব দিয়েছেন অন্য কিছু বলেন নি।

৩. ইমাম শাফেয়ী (রহ.) বলেন : আমি বাগদাদ হতে বের হয়ে ইমাম আহমাদের চেয়ে অধিক আল্লাহভীরু, তাকওয়াশীল, ফাকীহ ও জ্ঞানী আর কাউকে পাইনি। 

ইমাম আহমাদ (রহ.)-এর ইন্তেকাল

জন্মের পরই মৃত্যুর পর্ব, আল্লাহ তা'আলার এ নিয়মের ব্যতিক্রম মহামানব মুহাম্মদ ﷺ -এর ক্ষেত্রেও ঘটেনি, ঠিক একই নিয়মের শিকার হলেন আহলুসসুন্নাহ ওয়াল জামাআতের ইমাম- ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহ.)। ২৪১ হিজরী ১২ রবিউল আউয়াল শুক্রবার সকল মাখলুককে ছেড়ে মহান খালিক এর ত্বরে পাড়িজমান। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করুন। আমীন!

ইমাম (রহ.)-এর জানাযায় এত বিপুল সংখ্যক মানুষের সমাগম হয় যে, ইমাম আব্দুল ওয়াহ্হাব আল ওয়ারাক (রহ.) বলেন : জাহেলী যুগে কিংবা ইসলামী যুগে এত বিপুল সংখ্যক মানুষের সমাবেশ ঘটেছে বলে আমাদের জানা নেই। খোলা মরুভূমিতে প্রথম জানাযা সম্পন্ন হয় যাতে পুরুষের সংখ্যা ছিল ৬-৮ লক্ষ, কেউ কেউ বলেন দশ লক্ষ, আর নারীর সংখ্যা ছিল ৬০ হাজার। এ ছাড়াও কয়েকদিন পর্যন্ত জানাযা চলতে থাকে।

জানাযার এ বিড়ল দৃশ্য প্রমাণ করে ইমাম আহমাদ সত্যিই সত্যিই আহলুস সুন্নাহ্ ওয়াল জামাআতের ইমাম।